বুধবার, ২৩ অক্টোবর ২০২৪, ০২:৪৭ পূর্বাহ্ন

সর্বশেষ সংবাদ :
বরিশাল মহানগর যুবদলের প্রস্তুতি সভা অনুষ্ঠিত কলাপাড়ায় সরকারি এম বি কলেজ মাঠ উন্মুক্ত করার দাবীতে মানববন্ধন কুয়াকাটায় বেড়িবাঁধ নির্মাণে সংরক্ষিত বনের বালু উত্তোলন, হুমকিতে সবুজ বেষ্টনী বঙ্গোপসাগরে নিম্নচাপ, উপকূলে গুমট পরিবেশ চন্দ্রদ্বীপ ইউনিয়নের রাস্তা সহ বিভিন্ন প্রকল্প পরিদর্শন করেন এলজিইডির টিম বাউফল নারীর বিদ্যমান প্রতিবন্ধকতা নিয়ে আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত বাউফলে ৮দিনের অভিযানে ১৯ জেলে আটক, প্রায় সাড়ে ৩ লক্ষ মিটার জাল জব্দ বাংলাদেশ মাধ্যমিক স্কুল শিক্ষক পরিষদ বরিশাল মহানগরীর প্রতিনিধি সমাবেশ কলাপাড়ায় নদী থেকে অবৈধভাবে মাটি কাটায় এক লাখ টাকা জরিমানা কুয়াকাটা পৌর বিএনপির অফিস ভাংচুর মামালায়, পৌর আওয়ামী লীগ সভাপতি সহ ৪ জন জেল হাজতে ডাকাত বাহিনীর প্রধান ২০মামলার আসামী জুয়েল মৃধা গ্রেপ্তার  কলাপাড়ায় এইচএসসিতে মহিপুর  মুক্তিযোদ্ধা মেমোরিয়াল ডিগ্রী কলেজ এগিয়ে ৫ দিন পাঞ্জা লড়ে মৃ-ত্যুর কাছে হার মানলেন সাবেক ইউপি সদস্য রফিকুল ইসলাম উপকূলের শিশুদের সাঁতার প্রশিক্ষণ শেষে প্রতিযোগিতা মহিপুরে অর্থের অভাবে অন্ধ হতে বসেছে শিশু তাওহিদ, সাহায্যের আবেদন
পটুয়াখালীতে জলে ভাসা জীবন ওদের,নেই কোন অধিকার

পটুয়াখালীতে জলে ভাসা জীবন ওদের,নেই কোন অধিকার

Sharing is caring!

বরিশাল : উপকূলের নৌকায় বসবাস করা মান্তা একটি জনগোষ্ঠী। নদীর জলে ভাসা নৌকায় তাদের জন্ম, বিয়ে, জীবন জীবিকা এবং মৃত্যু। দেশের বিভিন্ন এলাকার নদী ভাঙা মানুষগুলোর পূর্বপুরুষের ঠিকানা হারিয়ে আশ্রয় জুটেছে জলে। নৌকায় তাদের আলাদা জগৎ, আলাদা এক রাজ্য। সভ্য সমাজ ব্যবস্থার সাথে রয়েছে রক্তের বন্ধন, রয়েছে জীবন জীবিকার সংযোগ। তবুও মান্তা জনগোষ্ঠীর জীবনে ছোঁয়া লাগেনি সভ্যতার, পায় না কোনো সরকারি সুবিদা। এ জনগোষ্ঠীর শিশুরা অধিকার বঞ্ছিত আর মানবতা বির্বজিত হয়ে বেড়ে উঠছে। তাদের ওই জীবন যেন আমাদের নাগরিক জীবনকে ব্যঙ্গ করে।
রশি বাঁধা ছেলেবেলা: পটুয়াখালী শহরে থেকে পূর্বদিকে প্রায় ৩৫ কিলোমিটার সড়ক পথ পেড়িয়ে বাউফল উপজেলার বগি খাল। পাশেই তেঁতুলিয়া নদী। ওই খালটি বাউফল ও দশমিনা উপজেলার সীমানা নির্ধারণ করা। খালের মধ্যে প্রায় শতাধিক নৌকা। ওই নৌকার মধ্যে শতাধিক পরিবারের বসতি। তেঁতুলিয়া নদীতে মাছ শিকার করে মান্তা পরিবারের লোকজন জীবীকা চালায়।
ভূখানাঙ্গা এ মানুষগুলো নদী ভাঙনের শিকার। ভিটামাটি আর পূর্ব পুরুষের ঠিকানা হারিয়ে এরা এখন যাযবর। নদীর জলের ওপর বসতি তাদের। মাছ শিকারের ওপর নির্ভরশীল এ মানুষগুলো যেখানে মাছের সন্ধান পায় সেই জলাশয়ের আশেপাশে নৌকা নোঙর করে। কোথাও মাথা গুজার ঠাঁই না পেয়ে সরকারি সবধরণের নাগরিক সুবিদা বঞ্চিত নৌকার এ বাসিন্দারা। জন্ম-মৃত্যু-বিয়ে এসবই হয় তাদের নৌকায়। তবে দাফন হয় মাটিতে। মান্তা পরিবারে শিশুরা ভূমিষ্ট হওয়ার পর তাঁদের বাঁচিয়ে রাখার স্বার্থে অভিভাবকরা কোমড়ে পড়িয়ে দেয় রশি। ওই রশি কোমড়ে নিয়েই বড় হয় শিশুরা। গোসলকরা, খাওয়া, ঘুম ছাড়া সারাক্ষণই শিশুরা নৌকায় রশি দিয়ে বাঁধা থাকে।
সরেজমিনে দেখা গেছে, নৌকায় নৌকায় শিশুরা রশি দিয়ে বাঁধা। ওই শিশুদের নানা ধরণের আকুতি। কেউ কাঁদছে, কেউ ঝুলে আছে, কেউবা আবার পানির মধ্যে হাত চুবিয়ে খেলা করার চেষ্টা। আবার কাউকে খালের পারে গাছের সাথে বেঁধে রাখা হয়েছে। এ ছাড়া মা তাঁর সন্তানকে বুকের দুধ খাওয়াচ্ছেন কিন্তু শিশুটির কোমড়ে ঝুলছে মোটা রশি। মায়ের কোলে থাকলেও কোমড়ে বাঁধা থাকে মোটা রশি। এভাবেই রশির সাথে আষ্টেপিষ্টে জড়িয়ে আছে মান্তা শিশুর জীবন। অপরদিকে শিশুর কোমড়ে রশি বাঁধতে ভুলে গেলেও বিপদ। সন্তানের কোমড়ে রশি বাঁধতে ভুলে যাওয়ায় গত একবছরে পটুয়াখালীর ৪ মান্তা পল্লীতে ৬ শিশুর মৃত্যু হয়। এরমধ্যে বগি খালে মৃত্যু হয়েছে দুইটি, গলাচিপার পানপট্টির খালে মৃত্যু হয়েছে দুইটি, রাঙ্গাবালী উপজেলার চরমোন্তাজ বাজারের স্লুইস খালে মৃত্যু হয়েছে একটি এবং গলাচিপার রামনাবাদ খালে মৃত্যু হয়েছে একটি মান্তা শিশুর। প্রতিবছরই পানিতে ডুবে মান্তা শিশুর মৃত্যু হয় জানালেন অভিভাবকরা। তবে যে ভাবে রশি দিয়ে শিশু নৌকায় বাঁধা থাকে তাতেও মৃত্যু ঝুঁকিতে থাকে শতভাগ। আর রশি বাঁধা না থাকলে মৃত্যু ঝুঁকি আরো বেড়ে যায় এমন বক্তব্য অভিভাবকদের। মান্তা পরিবারের অভিভাবকদের সাথে কথা বলে জানাগেছে, শিশু জন্মের দুই থেকে তিনদিন পরই সন্তানদের কোমড়ে মোটা রশি পড়িয়ে দেয়া হয়। কারণ নৌকায়ই সার্বক্ষণিক তাদের বসবাস। তাই নদীতে অনেক সময় ঢেউ থাকে তাতে নৌকা দোলে তখন সদ্য ভূমিষ্ট হওয়া শিশুটি পানিতে পড়ে যেতে পারে। এ কারণে কোমড়ে জন্মের দুই এক দিনের মধ্যেই রশি লাগানো হয়। ওই রশির অভিশাপ থেকে পাঁচ কিংবা ছয় বছরের আগে (সাঁতার শেখা পর্যন্ত)মুক্তি মেলে না মান্তা শিশুর। এ রশি শিশুকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য অভিভাবকদের হাতিয়ার হলেও কখনো কখনো রশি নির্মম হয়ে ওঠে শিশুর প্রাণনাশে।
আমানত সরদার জানান, তিন বছর আগে তাঁর দুই বছরের শিশু সন্তান রুবেলকে রশি দিয়ে নৌকায় বেঁধে রাখে স্ত্রী রাহিমা বেগম। তখন তিনি নৌকায় ছিলেন না। কাজে ব্যস্ত থাকা রাহিমা বেগমের অজান্তে রুবেল রশি বাঁধা অবস্থায় নৌকা থেকে নদীতে পড়ে মারা যায়। পরে রশি থাকার কারণে খুব সহজে রুবেলের মৃতদেহ পাওয়া যায়। সহজে মৃতদেহ পাওয়াটা তাদের এক ধরণের সান্তনা। এ রকম ঘটনা মাঝেমধ্যে মান্তা পরিবারে ঘটে এমন দাবি ওই অভিভাবকের। মান্তা পরিবারগুলো শিশুদের রশির বন্দি দশা থেকে মুক্তি চায়। নৌকা থেকে ভূমিতে বসবাসের স্বপ্ন তাঁদের। কিন্তু কিনারা খুঁজে পায় না। বিভিন্ন মান্তা পরিবারের সদস্যরা জানান, তাঁদের বেঁচে থাকার মতো নৌকা, বড়শি আর জাল ছাড়া কিছুই নাই। ভাসতে ভাসতে যেখানেই তারা নোঙর করে ওই এলাকার প্রশাসন কিংবা জনপ্রতিনিধিরা এদের নাগরিক হিসাবে গ্রহণ করে না। বিভিন্ন এলাকা থেকে নৌকায় ভাসা ওই মানুষগুলোর আস্তানা হয় নদী কেন্দ্রিক। ফলে যে এলাকায় অবস্থা নেন ওই এলাকার জনপ্রতিনিধিরা মনে করেন তারা তাদের ভোটার না এ কারণে কোনো ধরণের সরকারি সুবিধা এরা পায় না। এ জন্য প্রশাসনের লোকজনও তাঁদের খোঁজখবর রাখে না। সারাক্ষণ জাল নৌকা নিয়ে পেটের ধান্দা মেটানোর তাগিদে জন্ম নিবন্ধন, জন্ম সনদ কিংবা মৃত্যু সনদ, জাতীয় পরিচয় পত্রের সাথেও এরা অপরিচিত।
মো. নুরু সরদারের স্ত্রী সেতারা বেগম বলেন, ‘আমার ৯ডা গুরাগ্যারা অইছেলে। একটা দড়ি (রশি) ছুইট্টা পানিতে ডুইব্বা মরছে। একটা মরছে অসুখ অইয়া। সাতউগা (সাত) বাইচ্চা আছে। য্যারা বাইচ্চা রইছে সবাইরে দড়ি দিয়া বাইনগা (বেঁধে) বড় করছি।
মো. আবুল হোসেন সরদার নামের এক অভিভাবক বলেন, ‘আমার দুইডা পোলা নদীতে পইড়া মরছে। পানিতে আর থাকতে মোল্লায় (ইচ্ছা) না। সরকার যদি আমাগোরে নদীর ধারে একটা জমি বা ঘর উডাইয়া দেয় চাষবাসের লইগ্যা খাস জমি দেয়। আমাগো পোলাপান  বাইনগা (বেঁধে) বড় করণ লাগবে না। ছাড়াইগা (ছেড়ে বা মুক্ত) পালতে পারমু। নদীতে থাহি দেইক্যা আমাগোরে কেউ কিছু দেয় না।
বগি এলাকার স্থানীয় এক বাসিন্দা মো. হেদায়েত মুন্সি আক্ষেপ করে বলেন, ‘গরু ছাগলের বাচ্চাও বাঁধন খুলে লালন পালন করা হয়। আর এরা মানুষের বাচ্চা হয়েও সব সময় বাঁধা থাকে। এদের জন্য সরকারের কিছু একটা ভালো কাজ করা উচিত। শিশুদের বেঁধে রেখে বড় করার এ ঘটনা আমাদের জীবনকে উপহাস করা ছাড়া আর কিছুই না।
পটুয়াখালী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের শিশু বিশেষজ্ঞ সহকারি অধ্যাপক মো. অহিদুজ্জামান শামীম বলেন, ‘জন্মের পর শিশুরা ধীরে ধীরে বেড়ে ওঠে। হামাগুড়ি দিয়ে চলাচলে ক্রমশ তাদের শারীরিক ও মানসিক বিকাশ শুরু হয় এবং শিশুরা বুঝে এবং শিখে। কিন্তু ওই বয়সে শিশুরা বন্দিদশার মধ্যে থাকলে অবশ্যই মানসিক বিকাশ বাধার মুখে পড়ে। ওইসব শিশুরা স্বাভাবিক ভাবে বেড়ে ওঠা শিশুর চেয়ে অবশ্যই আলাদা স্বভাবের হবে। পানি বা ভাসমান জীবন থেকে ওই জনগোষ্ঠীকে বের করতে পারলে ওই শিশুরাই স্বাভাবিক এবং সুস্থ ভাবে বেড়ে উঠবে।
পুতুল খেলার বয়সে বিয়ে: মাত্র তের বছর বয়স পেড়িয়ে চৌদ্দতে পড়েছে নুপুরের বয়স। এরইমধ্যে নুপুর চার মাসের অন্তস্বত্ত্বা। নুপুরের ব সাথে দেখা হয় বগি খালে। নুপুর তাঁর বড় বোন আছিয়ার সাথে নৌকা নিয়ে তেঁতুলিয়া নদীতে মাছ শিকারে যাচ্ছে। সে বলেন, ‘বাপ মায় গত বছর বিয়া দেছে আমি কি করমু।’ তাঁর স্বামীর নাম শিপন। ওই জনগোষ্ঠীর সন্তান, বয়স ১৬ বছর। নুপুর আরও বলেন, ‘আমরা গরিপ (গরিব) আমাগো মাছ ধইরগাই সংসার চলে। আমাগো নৌকার সবাইর বিয়া ১২, ১৩ বচ্ছর বয়সে অয়(হয়)।
নুপুরের সাথে কথা শেষ না হতেই দেখা মেলে আরেক শিশুবধূ মরিয়মের সাথে। মরিয়মের বয়স ১৪ কিন্তু সে এক সন্তানের জননী। সেও ওই নদীতে মাছ শিকার করে। এ সময় পাশে দাড়িয়ে থাকা আরেক শিশুবধূ রাবেয়া। তাঁর কোল জুড়ে রয়েছে এক বছরের শিশু সুজন। রাবেয়ার বয়স চৌদ্দ বছর। তাঁর চোখে মুখে এখনও শিশু বয়সের ছাপ। তবুও জীবন খেলায় ব্যস্ত শিশু রাবেয়া। নিজের শিশু বয়স অথচ সন্তান জন্ম দিয়ে বইছে আরেক শিশুর বোঝা। কত বছর বয়সে বিয়ে হয়েছে তা স্পষ্ট করে বলতে পারেনি রাবেয়া। তবে কপাল কুচকে আর মাথা হেলিয়ে রাবেয়া বলেন, ‘বিয়া অইছে তিন বচ্ছর তো-অইবেই। আমার যহন বিয়া অইছে তহন আমি হাফ প্যাট পড়ি।
পটুয়াখালীর বাউফল ও দশমিনা উপজেলার সীমানা নির্ধারণ করা বগি খালে রাবেয়ার নৌকা। স্বামী রুবেল সরদার। ওই বহরের অন্য নৌকার লোকজনের সাথে কথা বলে জানাগেছে, রাবেয়ার যখন বিয়ে হয়েছিল তখন তার (রাবেয়া) বয়স ১০ বছরের বেশী হয়নি। বিয়ের দুইদিন পরই স্বামীর সংসার সাজাতে দায়িত্ব শুরু। ইতিমধ্যে এক সন্তানের মা সে। শিশু বয়সেই ভেঙে পড়েছে রাবেয়ার শরীর।
এ প্রসঙ্গে রাবেয়া বেগম আরো বলেন, ‘বিয়ার বয়স অইছে দেইক্যাই বাপ-মায় বিয়া দেছে। নৌকার সবাই ওই অয়সেই বিয়া অয়। অক্টোবরের মাঝামাঝি সময় চর কাজল খালে মান্তা পরিবারের কুলসুম বিবির সাথে বিয়ে হয় রিপন সরদারের। খুবই দুর্বল শারীরিক কাঠামো নিয়ে স্বামীর সংসার শুরু করেছে কুলসুম। কুলসুম বলেন, ‘বাপ-মায় বিয়া দেছে, আমি কি করমু। বিয়ার বয়স না অইলে কি বিয়া দেতে?’
বাল্যবিয়ে দিয়ে জীবন শুরু হওয়ার এ অবস্থা শুধু রাবেয়া, মরিয়ম, নুপুর আর কুলসুমের জীবনই আসেনি। মান্তা সম্প্রদায়ের প্রতিটি নৌকায় যে মেয়েদের বিয়ে হয় সবাই এ নিয়মে বাঁধা। পটুয়াখালীর বিভিন্ন নদী তীরবর্তী এলাকায় নৌকায় বসবাস করা মান্তা পরিবারের মেয়েরা শিশুবধূ হয়েই সংসার শুরু করে। এটি অভিশাপ হলেও অভিভাবকরা মনে করেন কন্যা বিদায়ের দায় মুক্তি। এ সংস্কৃতি এদের জীবনকে খামছে ধরেছে। কত বছর বয়সে কন্যা সন্তানের বিয়ে দেয়া উচিত তা জানে না মান্তা পরিবারের অভিভাবকরা। এমনকি বিয়েতে কাজী দ্বারা রেজিষ্ট্রির করার বিষয়টিও তারা আমলে নেন না। ফলে প্রয়োজন হয় না বর বা কনের জন্ম সনদের। মূলত এসব বিষয়ে তাঁদের কোন ধারণাই নাই।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, জেলার বাউফল উপজেলার নারাইনপুর খাল, কালাইয়া খাল, হোগলা খাল, তালতলি খাল, গলাচিপা উপজেলার উলানিয়া খাল, পক্ষিয়া খাল, চরকাজল খাল, বোয়ালিয়া খাল, পানপট্টি খাল, বদনাতলী খাল, রামনাবাদ খাল, পাউট্টা খাল ও ডেবপুরা খাল, রাঙ্গাবালী উপজেলার ছোটবাইশদিয়া খাল, চালিতাবুনিয়া খাল, বড় বাইশদিয়া খাল, কোড়ালিয়া খাল ও চরমোন্তাজ স্লুইস বাজার খালে প্রায় ১০ হাজারের অধিক সংখ্যক মান্তা পরিবারের নৌকায় জলে ভাসে। ওইসব পরিবারের সিংহভাগ মেয়েদের ১০থেকে ১৩ বছর বয়স হলেই অন্য নৌকায় পাত্র খুঁজে বিয়ে দেয়া হয়।
বগি খালের কদম আলীর স্ত্রী পিয়ারা বেগম (৩০) জানান, আট কিংবা নয় বছর বয়সে তাঁর বিয়ে হয়। বর্তমানে পাঁচ সন্তানের জননী তিনি। অভিভাবকরা শিশু বয়সে কন্যা সন্তানকে বিয়ে দেয়ার জন্য অস্থির হয়ে ওঠেন। বিয়েতে কাজী ডাকা হয় না। শুধু কলেমা পড়িয়ে বকুল বলতে পাড়া একজন হুজুর বা মৌলুবি ডেকে কন্যা শিশুকে বিয়ে দেওয়া হয়।
পিয়ারা আরো বলেন, ‘বিয়া ছাড়া আমাগো নৌকার মাইসস্যের (মানুষের) কোনো আনন্দ অয় না। আনন্দ ফুর্তির লইগ্যা কোম বয়সে মাইয়াগো বিয়া অয়। আর বোঝেন-ই-তো স্যার বিয়ার লইগ্যা এউক্কা (একটা) পোলা, আর এউক্কা মাইয়া অইলেই অয়। আমাগো নৌকায় গুরাগ্যারার (ছেলে-মেয়ে) অভাব নাই। কোম বয়সে বিয়া অইলেও বয়স তো বাড়তেই থাহে। আমি সাবল্লক (সাবালিকা) অইছি স্বামীর নৌকায় যাইয়া। আমার বিয়ায় নৌকার মাইস্যে খুবই আনন্দ ফূর্তি করছে।
প্রায় একই ধরণের বক্তব্য দেন, কালু সরদারের স্ত্রী তিন সন্তানের জননী রাহিমা বেগম (২৮), শুক্কুর সরদারের স্ত্রী সূর্য বেগম (১৫) (সূর্য বর্তমানে গর্ভবতী)। রিপন সরদারের স্ত্রী এক সন্তানের জননী মুক্তা বেগম (১৬)। এদের সবারই বিয়ে হয়েছে ১৩ বছর বয়সের মধ্যে। অভাব আর বিচ্ছিন্নতার কারণে মান্তা জনগোষ্ঠী জীবনে কোনো সামাজিক, রাষ্ট্রীয় কিংবা ধর্মীয় উৎসবের ছোঁয়া লাগে না। এ কারণে শুধু বিয়েই তাদের একমাত্র উৎসব। তাই বিধি বিধান না জানা এবং সচেতনতার অভাবে ছোট ছোট শিশুদের বিয়ে দিয়ে এরা আনন্দ ফূর্তি করে নৌকায়।
এরা পরিকল্পিত পরিবার সম্পর্কেও অজ্ঞ। কারণ এদের নৌকা বহরে পা পড়ে না কোন স্বাস্থ্য কর্মীর। সরকারের এদের জন্য নেই কোন পরিকল্পনা। তাই জন্ম নিয়ন্ত্রণ কি তা তারা জানে না এবং শিশু স্বাস্থ্য সম্পর্কেও এরা অসচেতন। ফলে ফি বছর পোয়াতি হয় মায়েরা। এসব এ কারণে অধিকাংশ মা ১৮ বছরের মধ্যে একাধিক সন্তানের জন্ম দেয়। তছাড়া বয়স যত বারে মান্তা মায়েদের সন্তানও তত বাড়ে। আনছার সরদারের স্ত্রী মিনারা খাতুন (৪৫) ৯ সন্তানের জননী। পরিবার পরিকল্পনা বা জন্ম নিয়ন্ত্রণ সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘ওইসব আমরা বুঝি না। আমাগোরে কেউ ওইসব কিছু কয় নাই। নদী ভাঙনের কারণে ভিটেমাটি হারিয়ে এরা জলে নৌকা ভাসিয়ে মাছ শিকার করে জীবিকা চালালেও এরা ফিরতে চায় ডাঙায়। একখণ্ড জমির মালিক হতে চায়। কিন্তু ভাগ্য বিড়ম্বিত এ মানুষগুলোর ওই দাবি কখনও জোয়ারের মতো নিজেদের মধ্যে তীব্র হয় আবার অভাবের কারণে ভাটার মতো বেমালুম ভুলে যায়। পেটের তাগিদে সারাক্ষণ নদীতে জাল কিংবা বড়শি নিয়ে ব্যস্ত থাকে তাই ওই দাবি নিয়ে তারা দায়িত্বশীল কোনো ব্যক্তির দরবারে যেতে পারে না। ফলে বঞ্চিতই থেকে যাচ্ছে বছরের পর বছর।
বাউফল ও রাঙ্গাবালী উপজেলার দায়িত্বে থাকা পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা মো. মাহাবুব হাসান ভূঁইয়া বলেন, ‘এদের স্থায়ী বসতির অভাবে পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরের মাঠ কর্মীরা এদেরকে সেবা দিতে পারছে না। কারণ এদের কোনো হোল্ডিং নম্বর নাই। তবে এ জনগোষ্ঠীর লোকজন যদি আমাদের কোনো কর্মীর কাছে গিয়ে সেবা চায় তা হলে আমাদের কর্মীরা সেবা দিতে বাধ্য। কিন্তু অসচেতনতার কারণে এরা কোনো কর্মীর কাছে সাধারণত যায় না। নদী তীরবর্তী এলাকায় আবাসন বা আশ্রয়ণ প্রকল্পে স্থায়ীভাবে বসবাসের ব্যবস্থা করা হলে আমাদের কর্মীরা এদেরকে সবধরণের সেবা দিতে পারবে।
জেলা মহিলা বিষায়ক কর্মকর্তা শাহিদা বেগম বলেন, ‘এসব জনগোষ্ঠীর জন্য মন্ত্রণালয় থেকে লিখিত পরিকল্পনা চাওয়া হলে আমরা তা প্রস্তুত করে দিব। তবে মৌখিকভাবে এই সম্প্রদায় সম্পর্কে এবং এদের জীবনমান সম্পর্কে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষে অবহিত করা হয়েছে।
জীবিকার সংজ্ঞা পাঁচে: সাত বছরের শিশু রাজিব। গভির তেঁতুলিয়া নদীতে মাছ শিকাররত অবস্থায় মাথা নুঁয়ে বলেন, ‘মাছ না ধরলে আমরা খামু কি। নৌকার ছোড বড় সবাই মাছ ধরে। আমাগো তো অন্য কোনো কাম নাই। মাছ পাইলে বেইচ্চা নগদ টাহায় চাউল কেনে বাবায়। মাছ না পাইলে টাহা ধার করে। আমাগোরে সরকার কোনো চাউল দেয় না। কেউই কিছু দেয় না। আমাগো কামাই আমাগোই করতে অয়।’ জীবনের বাস্তবতায় সাত বছর বয়স পার হওয়া শিশু রাজীবের এসব কথা ঠোটের আগায় খইয়ের মতো ফোটে।
রাজিবের সাথে কথা বলে আরো জানা যায়। শিশু বয়স থেকে মাছ শিকার করা মান্তা শিশুদের রেওয়াজ। এটাই তাঁদের একমাত্র জীবিকা। বেঁচে থাকা, বর্তমান অথবা ভবিষ্যৎ এসবই নদীর মাছ শিকারকে ঘিরে। তাই মাছ শিকারে বয়সের কোন সীমা রেখা নেই। নৌকায় বসবাস করা মান্তা জনগোষ্ঠীর অভিভাবকরা সন্তান জন্মের দুই থেকে তিনদিনের মধ্যে শিশু সন্তানদের সাথে নিয়েই মাছ ধরতে নদীতে যায়। বয়স বাড়ার সাথে সাথে মান্তা শিশুরাও ওই কর্মকে আপন করে নেয়। নদীই হয় তাদের একমাত্র ভবিষ্যৎ। একপর্যায়ে শিশুর বয়স পাঁচ থেকে ছয় বছর অতিক্রমের পর শিশুদের আলাদা নৌকা এবং জাল কিংবা বড়শি দিয়ে নদীতে পাঠানো হয়।
তেঁতুলিয়া নদীর বহরমপুর এলাকায় রাজিব, সবুজ, মনোয়ার এবং সুজন একটি নৌকায় চার জন মিলে জাল দিয়ে মাছ শিকার করছে। ওরা চারজনই মান্তা শিশু। বয়স সাত থেকে ১০ বছরের মধ্যে। ওদের নৌকার বহর বগি খাল এলাকায়। প্রায় দুই বছর ধরে ওরা নদীতে কোনো অভিভাবক ছাড়াই মাছ শিকার শুরু করেছে। চার পরিবারের সন্তান ওরা চারজন প্রতিদিন যে পরিমাণ মাছ শিকার করে তা বিক্রি করে সমানভাবে টাকা ভাগ করে নেয় পরিবারের অভিভাবকরা।
তেঁতুলিয়া নদীর চর মুয়াজ্জিনের দক্ষিণ পার্শ্বে দেখা গেছে অসংখ্য শিশু জীবিকার তাগিদে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে মাছ ধরছে। ৫ থেকে ১২ বছর বয়সী ওইসব শিশুরা কিনারাহীন তেঁতুলিয়া নদীতে কেউ জাল, কেউবা আবার বড়শি দিয়ে মাছ ধরে। তাদেরই দুইজন মঙ্গল আলী (৮) এবং শুক্কুর আলী (১০)। মান্তা সম্প্রদায়ের এই দুই শিশু সম্পর্কে ভাই। বছরের সব মৌসুমেই ওরা নদীতে মাছ ধরে। দুই ভাই ছোট নৌকা নিয়ে বড়শি দিয়ে নদীর গভীর পানিতে মাছ শিকার করা তাদের নিয়মিত কাজ। দৈনিক ২০০ থেকে সর্বোচ্চ ৬০০ টাকা পর্যন্ত দুই ভাই মাছ শিকার করে আয় করে। কখনও আবার খালি হাতে ফিরতে হয় তাদের।
মঙ্গল ও শুক্কুরের বাড়ি বরিশাল সদর উপজেলার সাহেবেরহাট এলাকায়। নদী ভাঙনের শিকার হয়ে এদের বাবা মা নৌকায় বসবাসের জীবন শুরু করেছে। বর্তমানে এদের নৌকা বহরের অবস্থান পটুয়াখালীর বাউফল উপজেলার বগি খালে। সকাল সন্ধ্যা তাদের কাজই শুধু মাছ শিকার। শুক্কুর আলী বলেন, ‘এক বচ্ছর আগে বইন্যায় (ঝড়ে) আমাগো দুই ভাইর নৌকা তলাইয়া গ্যাছেলে, কাঠ ধইরগা বাচ্চি দুইজনে। পড়ে একটা ট্রলারের লোকজন আইয়া আমাগোরে নদীর তোন উডাইছে।’ বর্ষা মৌসুমে কিংবা দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়ায় এ রকম শিশু জেলেদের নৌকা ডুবির ঘটনা ঘটে প্রতিবছরই।
কারণ হিসাবে মান্তা পরিবারের একজন অভিভাবক আব্দুল আলী বলেন, ‘গুরাগ্যারায় ঝড় বইন্যার সোময় নৌকা ঠিকমত দইরগা রাখতে পারে না। হেইয়ার লইগ্যা ডুইব্বা যায়।’
আব্দুল হাই সরদার বলেন, ‘আমাগো তো উপায় নাই। মাছ তো সব সময় পাওন যায় না। এ লই¹া পরিবারের খরচ মিডাইতে ছোড বড় সবাই মাছ ধরে নদীতে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, পটুয়াখালী জেলার বিভিন্ন নদী ও খালে নৌকায় ভাসমানভাবে বসবাস করা পাঁচ থেকে সাত বছরের শিশুর সংখ্যা প্রায় চার হাজার। মূল ভূখণ্ডের সাথে মান্তা পরিবারের স্থায়ী যোগসূত্র না থাকায় এসব প্রান্তিক আয়ের পরিবারগুলোর শিশুদের ভবিষ্যৎ মানে কালো অন্ধকার। অধিকার হারা এসব শিশুরা জীবনের তাগিদে জীবিকার সন্ধানে ঝুঁকছে ঝুঁকিপূর্ণ পেশায়।
অবহেলিত হত দরিদ্র মানুষের ভাগ্য উন্নয়নের জন্য কাজ করা বেসরকারি প্রতিষ্ঠান স্পিড ট্রাস্ট এর বিভাগীয় সমন্বয়কারী মো. হেমায়েত উদ্দিন বলেন, ‘মান্তা শিশুদের শিশু শ্রম, বাল্যবিয়ে, শিক্ষা, স্বাস্থ্য এসব বিষয়গুলোর ওপর সরকারের সুস্পষ্ট নীতিমালা থাকা দরকার।
স্থায়ী বসতির মাধ্যমে মূল ভূখন্ডে এদের পুন:র্বাসন করা হলে এরা এ সমাজ ব্যবস্থার মূল স্রোতে ফিরবে। তা না হলে এখন যে ধারায় এরা রয়েছে তাতে মনে হয় সভ্য এবং আধুনিক সমাজ ব্যবস্থায় এদেশের নাগরিক হয়েও ভিন গ্রহের মানুষই থেকে যাবে।
বিষয়টি নিয়ে পটুয়াখালী সমাজসেবা অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক শিলা রানী দাস বলেন, এসব জনগোষ্ঠীর শিশুরা যদি লেখাপড়া করে তা হলে সমাজসেবা দপ্তরের মাধ্যমে উপবৃত্তি দেওয়ার বিধান রয়েছে। আর এ সুবিধা পেতে হলে অবশ্যই ওই পরিবারকে বাংলাদেশের নাগরিক হতে হবে। পরিচয়পত্র থাকতে হবে অভিভাবকদের। কিন্তু এরা ভাসমান হওয়ায় অনেকেরই পরিচয়পত্র নাই। পুনর্বাসনের মাধ্যমে এদের জীবন মান পরির্বতন করা সম্ভব।
টিকার ছোঁয়া নাই কারও শরীরে : দুই সন্তানের জননী রাহিমা বগম। ১৬ বছর বয়স তাঁর। সন্তান মস্তফা এবং ইউনুচের বয়স যথাক্রমে একজনের দুই বছর, অপরজনের আট মাস। মা ও দুই সন্তান কারো শরীরে মাতৃত্বকালিন কিংবা শিশু বয়সের একটি টিকা স্পর্শ করেনি। মা রাহিমা বলেন, ‘আমাগো দারে কেউ আয় না, আমরা টিহাও (টিকা) দেই না। এই টিহার কতা আমরা কিছুই জানি না। টিহা না দেলেও-বা কি অয়। আমরা তো ভালোই আছি। নিরাপদ মা হওয়ার জন্য টিকা পায় নি রাহিমা। আবার তাঁর দুই শিশু মস্তফা এবং ইউনুচও ঝূঁকিপূর্ণ রোগের প্রতিষেধক ইপিআই এর টিকা বঞ্ছিত হয়ে বেড়ে উঠছে। অথচ কথা ছিল রাহিমা মা হওয়ার আগে ১৫ বছর বয়স থেকে পর্যায়ক্রমে পাঁচটি টিটেনাস টকসাইড (টিটি) টিকা পাবেন। প্রথম টিকা নেওয়ার এক মাস পর দ্বিতীয়টি এর ছয় মাস পর তৃতীয়টি এর এক বছর পর চতুর্থ এবং আরেক বছর পর পঞ্চম টিকা পাওয়ার কথা। কিন্তু ওই টিকার ডোজ ছাড়াই মা হয়েছেন রাহিমা। পক্ষান্তরে তাঁর দুই সন্তান মস্তফা এবং ইউনুচেরও একই অবস্থা। মস্তফার বয়স দুই বছর পেড়িয়ে গেলেও একটি টিকা দেয়া হয়নি। আবার ইউনুচের বয়স আট মাস অতিবাহিত হয়েছে সেও পায়নি টিকা। শিশুদের ঝুঁকিপূর্ণ রোগ থেকে মুক্তির জন্য সরকার বাধ্যতামূলক ৬টি টিকা পর্যায়ক্রমে বিসিজি বা যক্ষ্ম (জন্মের  পরপর), পেন্টা বা (জন্মের ৪২ দিন হলেই), ডিপিটি বা হেপাটাইটিস-বি, হিপ, ডিফথেরিয়া, হুপিং কাশি, ধনুষ্টংকার ডোজ, বিওপিভি বা পলিও ভ্যাকসিন (জন্মের ১৪ দিন মধ্যে প্রথম ডোজ), পিসিভি বা নিউমোকক্কাল জনিত নিউমোনিয়া (শিশুর বয়স ৬ সপ্তাহ থেকে এর ডোজ শুরু হয় মোট তিনটি ডোজ) আইপিভি বা ইন অ্যাকটিভেট পলিও ভ্যকসিন এবং এমআর বা হাম ও রুবেলা (প্রথম ডোজ ৯ মাস পূর্ন হলে এবং ১৫ মাস পূর্ণ হলে দ্বিতীয় ডোজ)।
রাহিমার স্বামী খোরশেদ সরদার বলেন, ‘আমারা সবাই নৌকায় থাহি, এহ্যানে তো কেউ টিহা লইয়া আয় না। সরকার আমাগোরে তরে (স্থল বা মূল ভূখণ্ড) থাহার ব্যবস্থা কইরগা দেলে আমাগো গুরাগ্যারায় (সন্তান) টিহা পাইতে। শুধু রাহিমা খোরশেদ দম্পত্তির সন্তানরাই টিকা বঞ্ছিত হচ্ছে না। মান্তা পরিবারের সব শিশু এবং শিশু মায়েরা ঝূঁকিপূর্ন রোগের টিকা বঞ্ছিত হচ্ছে। গুরুত্বপূর্ণ ওইসব টিকার সাথে এরা সম্পূর্ণ অপরিচিত। প্রতিবছর হাজার হাজার শিশু ওইসব টিকা ছাড়াই বেড়ে উঠছে।
একই বহরে থাকা পাঁচ সন্তানের জননী পিয়ারা বেগম (৩০) বলেন, ‘এইহানে (এখানে) যতগুলা নৌকা দ্যাহেন এইসব নৌকায় যতগুলা পোলাপান দ্যাহেন একটা পোলাপানও কোনো টিহা পায় নাই। আমাগোরে কেউ কিছু দেয় না, ভাই। আমরা নৌকার মানুষ এই লইগ্যা সবাই আমাগোরে বাদ দিয়া কাম করে। মানুষ বইল্লা (হিসাবে) আমাগোরে সরকার, মেম্বার, চেয়ারম্যান কেউই মোনে করে না। আমার পাঁচটা পোলাপান অইছে কেউ একটা টিহা পায় নাই।’ একই অভিযোগ করেন দুই সন্তানের জননী ময়না বেগম, তিন সন্তানের জননী আসমা বেগম, চার সন্তানের জননী সাহারা খাতুন।
বগি খালের মান্তা বহরে এমন অভিযোগের সাথে সহমত পোষণ করেন গলাচিপা উপজেলার পানপট্টি ও রাঙ্গাবালী উপজেলার চরমোন্তাজ এলাকার স্লুইস বাজার খালের মান্তা বহরের লোকজন। পানপট্টি বহরের চার সন্তানের জননী নয়ন তারা, পাঁচ সন্তানের জননী সুরাইয়া বেগম, তিন সন্তানের জননী রেহেনা বেগম, বগি খালের পিয়ারা বেগমের মতোই একই সুরে কথা বলেন।
তাদের দাবি নৌকায় বসবাসের পরির্বতে স্থলে বসবাসের সুযোগ পেলে তাদের সন্তানরা ওইসব টিকার সুবিদা পেত। চরমোন্তাজ স্লুইস বাজার খালের আসমা বেগম দ্বিতীয় সন্তানের মা ১০ দিন আগে। ইপিআইএর টিকা সম্পর্কে কোনো ধারণা না থাকলেও আসমা বলেন, ‘স্যার আমাগোরে মাগনা (বিনামূল্যে) টিহা (টিকা) দেয় না। অন্য কোনো কিছুই দেয় না মাগনা।’ আসমার কোনো সন্তান পায়নি একটি টিকা।
এ ছাড়া ইপিআই কার্যক্রমের আওতায় বছরে দুইবার শিশুদের ভিটামিন এ ক্যাপসুল খাওয়ানো হয়। ক্রিমিনাশক অষুধ খাওয়ানো হয় বছরে দুইবার। গর্ভবতী মায়েদের এএনসি ও পিএনসি নামের দুইটি সেবা প্রদানকরা হয় মাঠ পর্যায়ের স্বাস্থ্য কর্মী দিয়ে। অর্থাৎ গর্ভকালীন অবস্থায় একবার এবং সন্তান প্রসবের পর আরেকবার মায়ের স্বাস্থ্য পরীক্ষার করার কথা এবং সন্তান প্রসবের পর ৪২ দিনের মধ্যে মাকে ভিটামিন এ ক্যাপসুল খাওয়ানো কথা থাকলেও এসব কোনো সুবিদা পায় না মান্তা জনগোষ্ঠীর শিশু মায়েরা।
এ ছাড়াও বিশ্বজুড়ে মহামারি করোনার টিকাও এরা পাচ্ছে না। কারণ তাদের অনেকেরই ভোটার আইডি কিংবা জন্ম সনদ নাই। মান্তা পরিবারের সদস্য নুপুর (১৪), মরিয়ম (১৪), শাবনুর (১৬) এরা সবাই বাল্যবিয়ের কারণে মা হয়েছেন। এমনই ওই জনগোষ্ঠীর জন্মসনদ কিংবা ভোটার আইডি না থাকার কারণে অধিকাংশ পরিবারের সদস্যরা করোনার ভ্যাকসিন থেকে বঞ্চিত।
মান্তা পরিবারের অভিভাবকরা জানান, তাদের এক সময় জমি ছিল, ঘর-বাড়ি, ভিটে-মাটি সবই ছিল। ছিল স্থায়ী ঠিকানাও কিন্তু বিভিন্ন নদীর হিংস্র থাবায় সব হারিয়ে এখন পানির ওপর নৌকায় বসবাস করছেন। সরকার নদী তীরবর্তী এলাকায় ওইসব পরিবারকে আবাসন প্রকল্পের মাধ্যমে ঘর এবং চরাঞ্চলে জেগে ওঠা খাস জমি বন্দোবস্তের ব্যবস্থা করলে পুনরায় আবার তারা স্থায়ী ঠিকানার বাসিন্দা হবে। তখন বঞ্চিত না হয়ে পাবে সরকারি সব সেবাগুলো।
বাউফল উপজেলার বগি এলাকায় দায়িত্বরত ইপিআই অস্থায়ী টিকাদান কেন্দ্রের স্বাস্থ্য সহকারী করুনা রানী বলেন, ‘এদের নিয়মিত পাওয়া যায় না এ কারণে এরা ইপিআই সেবা থেকে বঞ্চিত। ঘরবাড়ি যাদের আছে তারা সবাই টিকা পায়। এরা ভাসমান হওয়াটাই মূল সমস্যা।’
বাউফল উপজেলা মেডিক্যাল টেকনোলজিস্ট ইপিআই মো. মাসুদুজ্জামান বলেন, ‘ইউপিআইর ভিটামিন এর ডোজ এবং টিটি ভাসমান মানুষরা পায়। তবে সবগুলো টিকা এরা পায় না। এর প্রধানতম কারণ স্থায়ী বসতি না থাকা।
মহিলা বিষায়ক কর্মকর্তা শাহিদা বেগম বলেন, ‘ভাসমান হওয়ায় আমরা এই মান্তাদের সচেতনও করতে পারছি না। এদের জন্য একটি পরিকল্পনা করে স্থায়ী বসতির আওতায় নিয়ে আসা হলে বাল্যবিয়ে বন্ধসহ এদের জীবনে ছন্দ ফিরে আসবে।’ বাউফল উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা প্রশান্ত কুমার সাহা বলেন, ‘টিকা খাওয়ানোর বিশেষ দিবসগুলোর টিকা এরা পায়। তবে সবগুলো টিকা পেতে হলে স্থায়ী বসবাস থাকা প্রয়োজন। এরা আজ এখানে তো কাল অন্য কোনো স্থানে এটাই সমস্যা। তবে স্থায়ী বসতি হলে হলে কিংবা ভোটার হলে জটিলতা থাকে না। বসতির অভাবে কেউ এভাবে টিকা বঞ্চিত হলে রোগ নির্মূল করা সম্ভব হবে না।
স্কুলে যাওয়ার তৃষ্ণা: ওদের কারো নাম সুমন। কেউ রফিক। কারো নাম মৌসুমী। আবার কারো নাম সাথী। ওদের আসল পরিচয় ওরা মান্তা পরিবারের সন্তান। ওদের অতীত নেই, বর্তমান আছে, ভবিষ্যৎ মানে কালো অন্ধকার। তেঁতুলিয়া পারের বগি এলাকার এসব শিশুরা নদীতে মাছ শিকার করে। কখনও নদীর জলে দলবদ্ধ হয়ে ডুব সাঁতারে খেলা করে। কখনও আবার তীরে ওঠে কানামাছি, চাড়া খেলা, দড়ি লাফ, দাড়িয়াবান্দাসহ নানা খেলায় মেতে ওঠে। কিন্তু এরা কেউ স্কুলে যায় না। নৌকায় বসবাস করা এসব মান্তা শিশুদের জন্য নদীতে কোন স্কুল নেই। আর অভাব মেটাতে এসব শিশুরা তীরে এসে স্কুলে যাওয়ার সময় পায় না, তাই ওরা লেখাপড়া বিমুখ। প্রজন্মের পর প্রজন্ম এভাবেই চলছে। পটুয়াখালী জেলার কয়েক হাজার মান্তা পরিবারের শিশুরা স্কুল, বই, খাতা, কলম, শিক্ষার এসব উপকরণের ছোঁয়া থেকে বঞ্চিত।
সরেজমিনে মান্তা পল্লীর বগি, পানপট্টি, কোড়ালিয়া এলাকায় গিয়ে দেখা গেছে শিশুরা বয়স্কদের মতো কেউ মাছ শিকারে নদীতে ব্যস্ত, কেউ আবার নদী থেকে ফিরে নানা মুখি খেলাধূলায় ব্যস্ত।
পানপট্টি এলাকায় অবস্থান করা শিশু শাকিল (৮) বলেন, ‘স্যার আমাগো তো ঘর বাড়ি নাই। এক বেলা মাছ না ধরলে আরেক বেলা ভাত খাইতে পারি না। আমনেই কন (বলেন) নৌকার তোন (নৌকা থেকে) তরে উইট্টা স্কুলে যামু না মাছ ধইরগা প্যাড বাচামু।
দলবদ্ধ হয়ে শাকিলের কথার সাথে একমত হয়ে ইমন, নয়ন, আয়শা. ফাতেমা, শাবনুর, নুর আলম, বিলকিস প্রশ্ন ছুড়ে দিয়ে বলেন, ‘স্যার আমনে কন (আপনি বলেন), প্যাড বাঁচামু না, স্কুলে যামু।
বগি এলাকার নয় বছরের মান্তা শিশু রফিক আক্ষেপ করে বলেন, ‘তরের গুরাগ্যারা (শিশুরা) স্কুলে যায়, ল্যাহাপড়া করে, হেরা ল্যাহাপড়া কইরগা বড় অইয়া অফিসার অয়, শিক্ষিত অয়। স্যার আমাগোও লেহাপড়া করতে মোন চায়। হ্যাগো মোতন (তাদের মতো) অইতে ইচ্ছা করে। আমাগো হেই ব্যবস্থা নাই। আর আমাগো টাহা পয়সাও নাই। মাছ ধরনে যে কত কষ্ট হ্যা (তা) আমরা বুঝি। স্কুলে যাইয়া ল্যাহাপড়া করতে পারলে মানুষ অইতাম। এ কথাগুলো বলার সময় রফিকের সাথে প্রায় ২০-এর অধিক শিশু উপস্থিত ছিল। তাদেরও স্বপ্ন বই খাতা নিয়ে স্কুলে যাওয়ার। বিদ্যার বর্ণ শিখে চোখের আলো ছড়িয়ে সব লিখতে চায় ওরা এবং বিশ্বকে জানতে সবকিছুই পড়তে চায়। কিন্তু স্কুলের ঘণ্টা বাজার শব্দ এসব মান্তা শিশুদের তাড়িত করলেও অবস্থান আর অভাবের কাছে এরা বারবার পরাজিত।
মান্তা পরিবারের বিভিন্ন অভিভাবকের সাথে কথা বলে জানা গেছে, তারাও বর্তমান যুগের সাথে সমান তালে থাকতে চান। তাই তাদের নৌকায় এখন ব্যবহার করেন সৌর বিদ্যুৎ, রয়েছে টেলিভিশনও। মোবাইল আছে অধিকাংশ নৌকায়। নদীতে অবস্থান এবং অভাবের ফলে সন্তানদের স্কুলে পাঠাতে পারেন না।
আরশেদ সরদার(৬৫) বলেন, ‘আমরা ভাসান জীবন বাদ দিতে চাই। সরকার যদি আমাগোরে নদীর ধারে ঘর বাড়ি কইরগ্যা দেয় তাহেলে আমাগো পোলাপনও লেহাপড়া করতে পারবে। দ্যাহেন-ই-তো আমনেগো আতে (হাতে)মোবাইল আছে, আমাগোও মোবাইল আছে। আমনেগো টিপি (টিভি) আমাগো টিপি আছে। আমাগো নাই ল্যাহাপড়া।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, পটুয়াখালী জেলার ১৪টি স্থানে মান্তা পরিবারের নৌকার বহর রয়েছে। ওইসব বহরে প্রায় দুই হাজারের অধিক শিশু প্রতিবছর স্কুলে ভর্তির বয়স হলেও(পাঁচ বছর) স্কুলে যায় না। বিভিন্ন মান্তা পল্লী ঘুরে দেখা গেছে স্কুলে যেতে সক্ষম প্রায় চার হাজাররের অধিক শিশু স্কুল বিমুখ। যতদিন যাচ্ছে ততই মান্তা পরিবারের নিরক্ষরের সংখ্যা বাড়ছে। শিশু বয়স থেকেই ওইসব শিশুরা পেশায় জেলে। নদীতে মাছ শিকার করে লেখাপড়ার পরির্বতে সংসারে আয়ের যোগান দেন।
জেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসার মোল্লা বখতিয়ার রহমান বলেন, ‘আমি ভাসমান জনগোষ্ঠী মান্তাদের নাম কখনও শুনিনি। খোঁজ নিয়ে এদের জরিপ করে স্কুলে ভর্তির ব্যবস্থা করা হবে।
পটুয়াখালীতে শিশুদের অধিকার নিয়ে কাজ করা শিশু অধিকার সুরক্ষা কমিটির সভাপতি শম দেলোয়ার হোসেন দিলিপ বলেন,একটি শিশু তাঁর মৌলিক অধিকার নিয়ে বড় হবে রাষ্ট্র তা নিশ্চিত করবে। যেহেতু মান্তা শিশুরা তাদের সব ধরণের অধিকার থেকে বঞ্চিত তাই রাষ্ট্র এ প্রজন্মকে অধিকার থেকে বঞ্চিত করছে। এদের অধিকার ফিরিয়ে দিতে রাষ্ট্রকে উদ্যোগ নিয়ে হবে এটা আমাদের দাবি আর আমরা সে লক্ষ্যে কাজ করে যাচ্ছি। মান্তাদের নদী তীরবর্তী এলাকায় আবাসান প্রকল্পের মাধ্যমে স্থায়ী বসবাস নিশ্চিত করতে পারলে এদের সামাজিক নিরাপত্তা নিশ্চিত হবে, ফিরে পাবে শিক্ষা, স্বাস্থ্য এবং বাসস্থানের অধিকার।
এ ব্যাপারে পটুয়াখালীর জেলা প্রশাসক মো. কামাল হোসেন বলেন, ‘মান্তাদের জীবন চলে, জীবিকাও চলে। কিন্তু শিক্ষা নেই মান্তা শিশুদের। স্থায়ী বাসিন্দা হওয়ার অভাবে এ জনগোষ্ঠীর শিশুরা বিদ্যার্জন করতে পারছে না।এ জনগোষ্ঠী ভাসমান থাকায় ভোটার হতে পারছে না। আমরা ইতিপূর্বে রাঙ্গাবালী উপজেলার চরমোন্তাজের ভাসমান ২৯ পরিবারকে ঘর তৈরী করে দিয়েছি, বিদ্যুৎ সংযোগ দেওয়া হয়েছে তাদের ঘরে। আর সরকারি সুবিদা পেতে সবাইকে ভোটার হতে হবে। আমরা তাদের ভোটার করারও ব্যবস্থা করেছি। ওখানে একটা স্কুল করে দেয়া হবে। গলাচিপা উপজেলায় ১০ পরিবারকে পুনর্বাসন করা হয়েছে। বাউফল-দশমিনা সীমানায় বগি খালে বসবাস করা অনেককে পুনর্বাসন করা হয়েছে। বাকি সবাইকে পুনর্বাসন করা হবে এ বছর। সবার ভোটার আইডি করে দেয়া হবে। যাতে এ জনগোষ্ঠী সরকারের সব ধরণের সুযোগ সুবিদা ভোগ করতে পারে।

নিউজটি আপনার বন্ধুদের সাথে শেয়ার করুন




© All rights reserved © crimeseen24.com-2024
Design By MrHostBD